ইসলামে ঘুমানোর সঠিক নিয়ম: সুন্নাহ ও স্বাস্থ্যগত উপকারিতা
ইসলামে জীবনের প্রতিটি দিকেই দিকনির্দেশনা রয়েছে, যার মধ্যে ঘুমানোর আদব বা নিয়মও অন্তর্ভুক্ত। ঘুম আমাদের শরীর ও মনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, যা শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে ঘুমের বিশেষ কিছু সুন্নাহ রয়েছে, যা একজন মুসলিমের দৈনন্দিন জীবনে স্বাস্থ্য এবং আধ্যাত্মিকতা উভয়ই বজায় রাখতে সাহায্য করে। এই ব্লগে আমরা ইসলামে ঘুমানোর সঠিক নিয়ম এবং এর উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করব।
১. ওজু করে ঘুমানো
ইসলামে ঘুমানোর আগে ওজু করা একটি সুন্নত। মহানবী (সা.) এর হাদিসে বলা হয়েছে, “যখন তুমি ঘুমাতে যাবে, তখন নামাজের জন্য যেমন ওজু কর, তেমনভাবে ওজু করে ঘুমাতে যাও” (বুখারি ২৪৭)। এই অভ্যাস শুধু আধ্যাত্মিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি শরীরকেও শুদ্ধ রাখে এবং পবিত্রতা বজায় রাখতে সহায়ক হয়।
২. ডান কাতে শোয়া
মহানবী মুহাম্মদ (সা.) ঘুমানোর সময় ডান দিকে কাত হয়ে শোয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ আছে, “তুমি তোমার ডান পাশে কাত হয়ে শোও” (বুখারি ২৩৯)। ডান পাশে শোয়া শুধুমাত্র একটি সুন্নাহ নয়, এর স্বাস্থ্যগত উপকারিতাও রয়েছে। ডান কাতে শোয়ার মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুসের উপর চাপ কমে, ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস সঠিকভাবে হয় এবং সারারাত আরামদায়ক ঘুম নিশ্চিত হয়।
৩. ঘুমানোর আগে দোয়া পড়া
ইসলামে ঘুমানোর আগে বিশেষ কিছু দোয়া পড়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে, যা আল্লাহর কাছে নিজের আত্মাকে সমর্পণ করার প্রতীক। মহানবী (সা.) ঘুমানোর আগে সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক, এবং সুরা নাস পড়ে নিজের ওপর ফুঁ দিতেন (বুখারি ৫০১৭)। এ ছাড়াও, তিনি এই দোয়াটি পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন:
"বিসমিকাল্লাহুম্মা আমুৎতু ওয়া আহইয়া"
অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনার নামে আমি মরি এবং জীবিত হই।” (বুখারি ৬৩২৪)
এই দোয়া পড়লে আল্লাহর রহমত এবং নিরাপত্তার অধীনে ঘুমানো যায়।
৪. বিছানা ঝেড়ে নেওয়া
ঘুমানোর আগে বিছানা ঝেড়ে নেওয়াও একটি সুন্নত। এক হাদিসে নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “তোমরা যখন বিছানায় শোবে, তোমাদের বিছানাকে ঝেড়ে নেবে, কারণ তোমরা জানো না বিছানায় কি আছে” (বুখারি ৬২৯)। এই অভ্যাস শুধু আধ্যাত্মিকভাবেই নয়, স্বাস্থ্যগতভাবেও উপকারী, কারণ এতে ময়লা বা পোকামাকড় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
৫. প্রথম অংশে ঘুমানো এবং শেষ রাতে জাগ্রত হওয়া
মহানবী (সা.) সাধারণত রাতের প্রথম ভাগে ঘুমাতেন এবং শেষ ভাগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য জাগ্রত হতেন। হাদিসে বলা হয়েছে, “তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া তোমার জন্য উত্তম, যা তোমার পূর্বসূরিরাও পালন করেছে” (তিরমিজি ৩৯০৬)। এই অভ্যাস শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য নয়, স্বাস্থ্যকর ঘুমের চক্র বজায় রাখতেও সাহায্য করে।
৬. উঠার সময় দোয়া পড়া
ইসলামে ঘুম থেকে উঠার পরও দোয়া পড়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, “যখন কেউ জাগ্রত হয়, সে এই দোয়া পড়বে: ‘আলহামদুলিল্লাহিল্লাযি আহইয়ানা বাআদা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর’ অর্থাৎ, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের মৃত্যুর পর আবার জীবিত করেছেন, এবং তার কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।’ (বুখারি ৬৩১২)।
৭. ঘুমানোর জন্য নির্দিষ্ট সময় রাখা
ইসলামে সময়ের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি, এবং ঘুমের জন্যও একটি নির্দিষ্ট সময় রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মহানবী (সা.) সাধারণত এশার নামাজের পর ঘুমাতেন এবং তাহাজ্জুদ নামাজের আগে জাগ্রত হতেন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, নিয়মিত ঘুমের সময়সূচি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৮. বাম দিকে বা উল্টো শোয়া নিরুৎসাহিত
মহানবী (সা.) বাম দিকে শোয়া বা পেটের উপর শোয়াকে নিরুৎসাহিত করেছেন। এক হাদিসে তিনি বলেন, “তোমরা পেটের উপর শোও না, কারণ এটি শয়তানের শোয়ার পদ্ধতি” (আবু দাউদ ৫০৪০)। এটি স্বাস্থ্যগতভাবেও ক্ষতিকর, কারণ পেটের উপর শোয়ার মাধ্যমে শ্বাসকষ্ট এবং শরীরের অন্যান্য অংশে চাপ পড়ে।
ইসলামে ঘুমানোর সুন্নাহ ও নিয়মগুলি শুধু আধ্যাত্মিক শান্তি অর্জনের জন্য নয়, বরং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাও নিশ্চিত করে। ওজু করে ঘুমানো, ডান দিকে কাত হয়ে শোয়া, দোয়া পড়া এবং পবিত্রতা বজায় রাখা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে আল্লাহর নৈকট্য ও কৃপা অর্জনে সহায়ক। এসব সুন্নাহ পালন করলে শুধু ইবাদতই নয়, স্বাস্থ্যও ভালো থাকে, এবং ঘুম হয়ে ওঠে প্রশান্তিময়।