বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জের মধ্যেও তামাক কোম্পানিগুলোর সফলতা বজায় রাখার কৌশল
তামাক কোম্পানিগুলো বছরের পর বছর ধরে কঠোর সমালোচনা এবং আইনগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে সারা বিশ্বে তামাকপণ্যের ব্যবহার কমে আসছে, সরকারের পক্ষ থেকে আরোপিত কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও কর আরোপের প্রভাবও তামাক শিল্পকে বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে। তবে, এসব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও তামাক কোম্পানিগুলো বেশ কয়েকটি কৌশল অবলম্বন করে তাদের ব্যবসায়িক সফলতা বজায় রেখেছে।
তামাক কোম্পানির চ্যালেঞ্জসমূহ
তামাক শিল্পকে একাধিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি প্রচারণা: গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে তামাকের ব্যবহার হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ নানা প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং বিভিন্ন দেশীয় স্বাস্থ্য বিভাগ তামাক ব্যবহার বিরোধী সচেতনতা প্রচারণা চালাচ্ছে, যা তামাকের চাহিদা কমাতে ভূমিকা রাখছে।
আইনি নিয়ন্ত্রণ ও শুল্ক: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তামাকপণ্যের উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয়ে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। ধূমপানবিরোধী আইন, কর বৃদ্ধি, এবং জনসাধারণের স্থানগুলোতে ধূমপানের নিষেধাজ্ঞা তামাক কোম্পানিগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তরুণদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি: তরুণ প্রজন্ম এখন অনেক বেশি সচেতন, তারা স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির দিকগুলো সম্পর্কে ভালভাবে জানে। ফলস্বরূপ, নতুন প্রজন্মের তামাকপণ্যের প্রতি আকর্ষণ কমেছে।
মামলা ও ক্ষতিপূরণ: তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অসংখ্য স্বাস্থ্যজনিত মামলার কারণে প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। এই ক্ষতিপূরণের বোঝা কোম্পানির মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তামাক কোম্পানিগুলোর সফলতা বজায় রাখার কৌশল
এত চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা সফলভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে। এর পেছনে কয়েকটি মূল কৌশল কাজ করেছে:
১. উদ্ভাবনী পণ্য বিকাশ
তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ঐতিহ্যবাহী তামাকপণ্য ছেড়ে নতুন ধরনের পণ্য বিকাশে মনোনিবেশ করেছে। যেমন, ই-সিগারেট (E-cigarette) এবং হিট-নট-বার্ন (Heat-not-burn) পণ্যগুলোর উদ্ভাবন। এই ধরনের পণ্যগুলোকে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, IQOS হলো ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালের (Philip Morris International) একটি হিট-নট-বার্ন ডিভাইস, যা তামাককে পোড়ানো ছাড়াই ব্যবহার করা যায়।
এই ধরনের পণ্যগুলো তামাক কোম্পানিগুলোকে ধূমপানবিরোধী আইন ও স্বাস্থ্য সচেতনতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করেছে এবং নতুন ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ করার সুযোগ করে দিয়েছে।
২. বৈশ্বিক বাজারে সম্প্রসারণ
তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল এবং উদীয়মান বাজারে স্থানান্তর করেছে। যেসব দেশে স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং আইনি নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলকভাবে দুর্বল, সেসব দেশে তামাকের চাহিদা এখনো বেশি। আফ্রিকা, এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ এখনও তামাকপণ্যের বিশাল বাজার তৈরি করে রেখেছে। এসব অঞ্চলে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে এবং চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছে।
৩. ব্র্যান্ডিং ও বিজ্ঞাপন কৌশল
তামাকপণ্যের সরাসরি বিজ্ঞাপন অনেক দেশে নিষিদ্ধ থাকলেও, তামাক কোম্পানিগুলো নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। প্যাকেজিং ও ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে তারা তাদের পণ্যগুলোকে আধুনিক এবং আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এছাড়া, খেলাধুলা, বিনোদন এবং ফ্যাশন ইভেন্ট স্পনসরশিপের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নিজেদের ব্র্যান্ডকে প্রচার করছে।
বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তরুণদের মাঝে আধুনিকতা ও সামাজিক অবস্থানের প্রতীক হিসেবে তামাকপণ্য প্রভাবিত করতে এই ধরনের কৌশল বেশ কার্যকর হয়েছে।
৪. বৈচিত্র্যময় বিনিয়োগ
তামাক কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগ কৌশলকে বৈচিত্র্যময় করেছে। অনেক কোম্পানি এখন খাদ্য, পানীয়, এবং ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে, যাতে তারা তামাকপণ্যের ওপর একক নির্ভরতা কমিয়ে মুনাফা বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, Altria এবং British American Tobacco তাদের তামাক ব্যবসার বাইরে বিনিয়োগ করে মুনাফা নিশ্চিত করার কৌশল নিয়েছে।
৫. আইনি মোকাবিলা ও লবিং
তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন দেশে শক্তিশালী লবিং গোষ্ঠী তৈরি করেছে, যারা তামাক বিরোধী আইন শিথিল বা বিলম্বিত করতে সক্ষম হয়েছে। তারা আইনি প্রক্রিয়া এবং নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। অনেক সময় তারা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে তারা তাদের পণ্য বাজারে ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
৬. ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে অংশীদারিত্ব
বেশ কিছু তামাক কোম্পানি নিজেদের ইমেজ উন্নয়নের জন্য ধূমপান বিরোধী উদ্যোগ ও গবেষণায় অর্থায়ন শুরু করেছে। তারা স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ধূমপানের ক্ষতি কমানোর জন্য নতুন প্রযুক্তি ও পণ্যের গবেষণায় লগ্নি করছে। এটি এক ধরনের দ্বিমুখী কৌশল, যা তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থাপিত করতে সাহায্য করে এবং একইসঙ্গে তাদের পণ্য বিক্রিতেও সুবিধা দেয়।
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে তামাকপণ্যের চাহিদা কমলেও, তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে তাদের সফলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। পণ্য উদ্ভাবন, বাজার সম্প্রসারণ, বিজ্ঞাপন কৌশল এবং আইনি লড়াই তাদের ব্যবসায়িক মডেলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদিও তামাকপণ্যের ক্ষতি এবং এর বিরুদ্ধে বৈশ্বিক আন্দোলন ক্রমেই বাড়ছে, তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক কৌশল পরিবর্তন করে বাজারে টিকে থাকার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করছে।
বিশ্বমনন ব্লগের সঙ্গে থাকুন আরও ব্যবসায়িক কৌশল এবং কর্পোরেট স্ট্র্যাটেজি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ জানতে!