টিকা বা ভ্যাকসিন: কাকে বলে, কোন রোগে কি টিকা, এবং ভ্যাকসিনের নাম

টিকা বা ভ্যাকসিন: কাকে বলে, কোন রোগে কি টিকা, এবং ভ্যাকসিনের নাম

আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, “টিকা নিতে হবে” বা “ভ্যাকসিন দিয়ে রোগ প্রতিরোধ করা যায়।” কিন্তু আসলে টিকা বা ভ্যাকসিন কী এবং এর কার্যকারিতা কীভাবে কাজ করে? টিকার ইতিহাস, বিভিন্ন রোগে ব্যবহৃত টিকার নাম এবং এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এই ব্লগে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

টিকা বা ভ্যাকসিন কাকে বলে?

টিকা বা ভ্যাকসিন হলো এমন একটি জীববিজ্ঞানিক পদার্থ, যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে উদ্দীপিত করে। এটি মূলত দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় করা জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস), বা সেই জীবাণুর এক বা একাধিক প্রোটিন বা ডিএনএ/আরএনএ অংশ দিয়ে তৈরি করা হয়। যখন ভ্যাকসিন শরীরে প্রয়োগ করা হয়, তখন ইমিউন সিস্টেম সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা ভবিষ্যতে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সহায়ক হয়।

টিকার কাজ কীভাবে হয়?

টিকার মূল কাজ হলো ইমিউন সিস্টেমকে প্রশিক্ষিত করা, যেন তা কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত থাকে। এটি কয়েকটি ধাপে কাজ করে:

  1. টিকা দেওয়ার ফলে শরীর সেই জীবাণুকে শিখে চিনে ফেলে।
  2. ইমিউন সিস্টেম সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
  3. পরবর্তীতে যখন সেই জীবাণু আসল সংক্রমণের মাধ্যমে আক্রমণ করে, তখন শরীর তা দ্রুত চিহ্নিত করে এবং প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।

কোন রোগে কি টিকা বা ভ্যাকসিন?

বিভিন্ন ধরনের টিকা বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে ব্যবহার করা হয়। নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু রোগ এবং তাদের জন্য ব্যবহৃত টিকার নাম দেওয়া হলো:


১. যক্ষ্মা (Tuberculosis - TB)

  • টিকার নাম: BCG (Bacille Calmette-Guérin)
  • কার্যকারিতা: শিশুদের মধ্যে যক্ষ্মা প্রতিরোধে কার্যকরী, বিশেষ করে মেনিনজাইটিস এবং মাইলিয়ারি যক্ষ্মার ক্ষেত্রে।

২. হেপাটাইটিস বি (Hepatitis B)

  • টিকার নাম: Hepatitis B Vaccine
  • কার্যকারিতা: হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক, যা লিভার ক্যান্সার এবং সিরোসিসের ঝুঁকি কমায়।

৩. হেপাটাইটিস এ (Hepatitis A)

  • টিকার নাম: Hepatitis A Vaccine
  • কার্যকারিতা: হেপাটাইটিস এ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে, যা জন্ডিস এবং লিভারের সংক্রমণ সৃষ্টি করে।

৪. পোলিও (Poliomyelitis)

  • টিকার নাম: OPV (Oral Polio Vaccine), IPV (Inactivated Polio Vaccine)
  • কার্যকারিতা: পোলিও ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়, যা পক্ষাঘাত ঘটাতে পারে।


৫. হাম (Measles)

  • টিকার নাম: MMR Vaccine (Measles, Mumps, and Rubella)
  • কার্যকারিতা: শিশুদের মধ্যে হাম, মাম্পস, এবং রুবেলা প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।

৬. ডিপথেরিয়া (Diphtheria)

  • টিকার নাম: DTP Vaccine (Diphtheria, Tetanus, Pertussis)
  • কার্যকারিতা: ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, এবং পার্টুসিস (হুপিং কাশি) প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।

৭. রোটাভাইরাস সংক্রমণ (Rotavirus Infection)

  • টিকার নাম: Rotavirus Vaccine
  • কার্যকারিতা: শিশুদের ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ রোটাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক।

৮. মানব প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV)

  • টিকার নাম: HPV Vaccine (Gardasil, Cervarix)
  • কার্যকারিতা: সার্ভিকাল ক্যান্সার এবং অন্যান্য এইচপিভি-জনিত সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।

৯. ইনফ্লুয়েঞ্জা (Influenza)

  • টিকার নাম: Influenza Vaccine (Flu Shot)
  • কার্যকারিতা: বার্ষিক ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয় এবং বিশেষত বয়স্কদের এবং কম ইমিউন সিস্টেমের ব্যক্তিদের জন্য কার্যকরী।

১০. করোনা ভাইরাস (COVID-19)

  • টিকার নাম: Pfizer-BioNTech, Moderna, AstraZeneca, Sinovac, Johnson & Johnson
  • কার্যকারিতা: কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয় এবং মারাত্মক সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়।

১১. যক্ষ্মা এবং হুপিং কাশি (DTP)

  • টিকার নাম: Pentavalent Vaccine
  • কার্যকারিতা: এই টিকা ৫টি রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়, যেমন ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, হুপিং কাশি, হেপাটাইটিস বি, এবং হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি।

১২. হাঁপানি (Pneumococcal Disease)

  • টিকার নাম: PCV (Pneumococcal Conjugate Vaccine)
  • কার্যকারিতা: নিউমোকোক্কাল ব্যাকটেরিয়ার কারণে নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, এবং অন্যান্য সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।

টিকার গুরুত্ব

টিকা গ্রহণের মাধ্যমে আপনি শুধু নিজেকে নয়, আপনার আশেপাশের মানুষকেও সুরক্ষা দিতে পারেন। যেসব মানুষ টিকা নিতে পারেন না (যেমন নবজাতক, গর্ভবতী নারী বা ইমিউনোপ্রমাইজড রোগী), তাদের সুরক্ষার জন্য ভ্যাকসিন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। একে হেরড ইমিউনিটি বলা হয়, যা সমাজের সর্বমোট সংক্রমণ ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।

টিকার সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

টিকা গ্রহণের পরে কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, যেমন:

  • হালকা জ্বর
  • টিকার জায়গায় লালচে বা ফোলাভাব
  • ক্লান্তি বা মাথাব্যথা

এই প্রতিক্রিয়াগুলো সাধারণত ক্ষণস্থায়ী এবং খুবই স্বাভাবিক। তবে, যদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুরুতর হয় বা দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

টিকা বা ভ্যাকসিন হলো স্বাস্থ্যসুরক্ষার অন্যতম প্রধান মাধ্যম, যা ব্যক্তি ও সমাজকে মারাত্মক রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। আজকের বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের রোগের বিরুদ্ধে টিকা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে নিরাপদ ও সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করছে। আপনি বা আপনার সন্তানের জন্য কোন টিকা প্রয়োজন তা জানতে এবং সঠিক সময়ে টিকা গ্রহণ করতে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।

প্রশ্ন বা পরামর্শ?

আপনার যদি আরও প্রশ্ন থাকে বা বিশেষ কোনো টিকা নিয়ে বিস্তারিত জানতে চান, মন্তব্য করতে ভুলবেন না!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন