অটিজম কী, লক্ষণ ও করণীয়

 অটিজম কী, লক্ষণ ও করণীয়

অটিজম একটি স্নায়বিক-বিকাশজনিত অবস্থার নাম, যা ব্যক্তি বিশেষের সামাজিক দক্ষতা, কথা বলা, আচরণ ও অনুভূতিতে বিভিন্ন রকমের প্রভাব ফেলে। এটি মূলত "অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার" (ASD) নামে পরিচিত এবং একে একটি 'স্পেকট্রাম' হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারণ এর লক্ষণ এবং প্রভাব ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। কেউ হালকা মাত্রার সমস্যায় ভুগতে পারে, আবার কেউ গুরুতরভাবে অটিজমের প্রভাব অনুভব করতে পারে।

অটিজমের সঠিক কারণ এখনও পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি, তবে এটি একটি জটিল স্নায়বিক অবস্থান যা পরিবেশ ও জেনেটিক প্রভাবের সংমিশ্রণে হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

অটিজমের লক্ষণসমূহ


অটিজমের লক্ষণ শিশুরা সাধারণত জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যে দেখাতে শুরু করে। লক্ষণগুলো তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়: সামাজিক দক্ষতা, যোগাযোগ এবং আচরণ।

১. সামাজিক দক্ষতা ও যোগাযোগের সমস্যা:
  • চোখের সংযোগ স্থাপন করতে না চাওয়া: অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত চোখের দিকে তাকাতে পছন্দ করে না বা সরাসরি চোখে চোখ রেখে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে।
  • সামাজিক সম্পর্ক গঠনে অসুবিধা: তারা অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে বা খেলতে আগ্রহী হয় না এবং বন্ধুত্ব গড়তে কষ্ট করে।
  • মুখের অভিব্যক্তি ও অঙ্গভঙ্গি বুঝতে না পারা: অন্য মানুষের অনুভূতি বুঝতে বা তাদের অভিব্যক্তি শনাক্ত করতে সমস্যা হতে পারে।
  • কথার বিকাশে বিলম্ব: অনেক শিশু দেরিতে কথা বলা শেখে বা একদম কথা বলে না। কেউ কেউ কথা বলতে পারলেও, সামাজিক যোগাযোগ বা অনুভূতি প্রকাশে অসুবিধা বোধ করে।
২. পুনরাবৃত্ত আচরণ:
  • একই কাজ বারবার করা: অটিজম আক্রান্ত শিশুরা একই ধরনের কাজ বারবার করতে পছন্দ করে, যেমন হাত নাড়ানো, ঘুরপাক খাওয়া বা কোনো বস্তু হাতের আঙুল দিয়ে বারবার স্পর্শ করা।
  • রুটিনে আটকে থাকা: রুটিন বা অভ্যাসে ছোটখাটো পরিবর্তন হলেও তারা বিরক্ত বা অস্বস্তি বোধ করতে পারে।
  • একটি বিশেষ আগ্রহ: তাদের কিছু নির্দিষ্ট জিনিস বা বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ থাকে, যেমন গাড়ির চাকা, সংখ্যা বা বিশেষ ধরনের খেলনা।
৩. সংবেদনশীলতা:
  • ইন্দ্রিয় সংবেদনশীলতা: অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা শব্দ, আলো, গন্ধ বা স্পর্শের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল হতে পারে। কিছু শিশু অস্বাভাবিকভাবে কোনো নির্দিষ্ট আলো বা শব্দে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, আবার কেউ কেউ কোনো স্পর্শ বা তাপমাত্রা পরিবর্তনও সহ্য করতে পারে না।

অটিজমের কারণ


অটিজমের সঠিক কারণ এখনও অজানা, তবে কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে, যেমন:

  • জেনেটিক প্রভাব: পারিবারিক ইতিহাসে অটিজম থাকলে এটি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু জিনের পরিবর্তন অটিজমের জন্য দায়ী হতে পারে।
  • স্নায়বিক বিকাশজনিত সমস্যাঃ মস্তিষ্কের কিছু অংশ সঠিকভাবে বিকশিত না হলে বা স্নায়বিক সিগন্যাল আদান-প্রদান করার ক্ষেত্রে সমস্যা হলে অটিজম হতে পারে।
  • পরিবেশগত প্রভাব: গর্ভাবস্থায় মায়ের সংক্রমণ বা পরিবেশগত ক্ষতিকর উপাদানের প্রভাবেও অটিজমের ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হয়।

অটিজমের চিকিৎসা ও যত্ন

অটিজমের কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, তবে কিছু থেরাপি ও সহায়ক পদ্ধতির মাধ্যমে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব:

  1. বিহেভিয়ারাল থেরাপি (ABA): এই থেরাপি শিশুদের সামাজিক দক্ষতা, যোগাযোগ, এবং আচরণগত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে শেখায়।

  2. স্পিচ থেরাপি: যারা কথা বলতে সমস্যা অনুভব করে, তাদের জন্য স্পিচ থেরাপি যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

  3. অকুপেশনাল থেরাপি: এটি দৈনন্দিন কাজগুলোকে সহজ করতে সহায়তা করে, যেমন খাবার খাওয়া, পোশাক পরা বা খেলার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া।

  4. শিক্ষাগত সহায়তা: বিশেষ শিক্ষকদের সহায়তা অটিজম আক্রান্ত শিশুদের শেখার প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়নে সহায়তা করে।

কীভাবে অটিজম আক্রান্ত শিশুকে সহায়তা করবেন

অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সঠিক যত্ন ও সমর্থন দিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো:

  • ধৈর্য ধরুন: তাদের চাহিদা ও অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাদের সাথে ধৈর্য্য ধরে কথা বলুন।
  • পর্যাপ্ত শিক্ষা দিন: অটিজম সম্পর্কে ভালোভাবে জানুন এবং সঠিক থেরাপি বা সহায়তার জন্য একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
  • রুটিনে সাহায্য করুন: একটি নিয়মিত রুটিন অনুসরণ করা অটিজম আক্রান্ত শিশুর মানসিক স্থিরতা এবং নিরাপত্তাবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
  • সামাজিক সংযোগ তৈরি করুন: অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিতে উৎসাহিত করুন।

অটিজম একটি চ্যালেঞ্জিং অবস্থান হলেও, সঠিক যত্ন ও থেরাপির মাধ্যমে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক ও শারীরিক উন্নতি সম্ভব। তাদের পরিবারের সহায়তা, স্কুলের ভূমিকা, এবং সমাজের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি সুখী ও সফল জীবনের পথে তাদেরকে এগিয়ে নিতে পারে।

অটিজম সম্পর্কে আরও জানতে ও সহযোগিতা পেতে আমাদের বিশ্বমনন ব্লগের সঙ্গে থাকুন!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন